মোঃ আব্দুল হান্নান রঞ্জন এডভোকেটঃ আমার এক প্রিয়জন, স্বজন, ঘনিষ্ঠজন হঠাৎ করে আমায় বললো, আপনি তো লেখালেখি করেন, আপনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে তার জীবন ও কর্ম নিয়ে লিখুন। আমি প্রায় হতভম্ব, ভাবতে লাগলাম কি লিখবো। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামতো বাংলা সাহিত্যে বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এক বিস্ময়, বিশালতায় ভরপুর এক নক্ষত্র। অসম্ভাবনার যুগে সম্ভাবনাময় এক অনন্য প্রতিভা- এই বিশাল মানুষটিকে নিয়ে লিখার মতো ধ্যান-জ্ঞাণ- অভিজ্ঞতা ও রিকোয়ারমেন্ট কোনটাই যে আমার নেই, তাঁকে নিয়ে লিখা আসলেই একটা সাহসের ব্যাপার, আর সেই সাহসটা তখনই আয়ত্ব হবে যাখন তার উপর ব্যাপক পড়াশুনা থাকবে।
তবে প্রিয়জন, আপনজনের এই তাগিদটা আমাকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে ধ্যান -জ্ঞাণ আহরণে আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে, এই কারণেই আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। “অগ্নিবীণা হাতে যাঁর প্রবেশ আর ধূমকেতু’র মতো ছিল যাঁর প্রকাশ” -তিনিই হলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৪ শে মে ( ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জৈষ্ঠ্য) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার অন্তর্গত। পিতামহ কাজী আমিনউল্লাহ’র পুত্র কাজী ফকির আহমেদের দ্বীতিয়া পতিœ জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তাঁর বাবা কাজী ফকির আহমেদ স্হানীয় এক মসজিদের ইমাম ছিলেন। সহোদর তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। তাঁর ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া।
মানুষের উপর মানুষের অতযাচার, নির্যাতন নিপীড়ন, সামাজিক অনাচার আর শোষণের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট ও সোচ্ছার প্রতিবাদই ছিল তাঁর কবিতার মূল টার্গেট বা বিষয়। মানুষে মানুষের মাঝে বিরাজমান বৈসম্য, দ্বন্দ আর হানাহানি তাঁকে ভীষনভাবে পীড়া দিতো বলেই তিনি লিখেছেন- গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান/যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম খ্রিস্টান /গাহি সাম্যের গান।” সাম্যের গান রচয়িতা নজরুল, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবি নজরুল, ধূমকেতুর কবি নজরুল, সুরের কবি নজরুল, বিদ্রোহী কবি নজরুল আমাদের প্রিয় কবি, জাতীয় কবি। কেননা নজরুলের ব্যক্তিত্বকে, মানুষ নজরুলকে, প্রেমিক নজরুলকে, কবি নজরুলকে, সঙ্গীতজ্ঞ নজরুলকে হিন্দু-মুসলমানের মিলন মৈত্রীর কবি নজরুলকে এ সমাজ বা মানুষ জাতি কোনদিন ভুলবে না। নজরুলের আগমন ঐতিহাসিক।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসের অনিশ্চয়তা, সামাজিক ক্ষেত্রে অন্যায়, অসাম্য, পরাধীনতার যন্ত্রণা এবং তা থেকে উত্তরণের ইচ্ছা বাঙালির এই সময়ের ভাবনায় ও ধ্যান-ধারনায় নজরুলের কবিতা নতুন আবেদন নিয়ে মানুষের এলো। বাংলা কাব্যে নজরুলের প্রথম বিদ্রোহ, পৌরুষ ও যৌবনের ভাষ্যকার এবং তার কবিতা আধুনিক কাব্যের ইতিহাসে নতুন পথ ও প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হল। নজরুল যে রবিতাপের বন্ধন ছিন্ন করে বের হতে পেরেছিলেন, তার কারণ ঐতিহাসিক নয় আকস্মিক। যেমন, রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিন্ন করার পটভূমিকা হলো – ( ১) মুসলমান হয়েও স্বভাবসুলভ গুণে তিনি হিন্দু মন ও মানসিকতাকে আপন করে নিয়েছিলেন। (২) তার বাল্য কৈশোর কেটেছে শহরে নয় মফস্বলে। (৩) ভদ্রলোক হওয়ার ইচ্ছা তার ছিল না। সেজন্য যাত্রা গান, লেটো গানের আসরে এবং শেষ পর্যন্ত সৈনিকের দলে যোগ দিয়েছেন। এগুলোই হয়ে গেল তার কবিতা লেখার উৎকৃষ্ট পটভূমি। (৪) যেহেতু নজরুলের পরিবেশ ছিল ভিন্ন, স্বভাব-প্রকৃতি ছিল সরল ও বিদ্রোহী ধরনের তাই তিনি রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কাব্যে নজরুল রবিতাপে হারিয়ে না গিয়ে প্রথম রবীন্দ্রনাথের মায়াজাল ভেঙ্গে বিদ্রোহের নিশান উড়িয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আওতা থেকে বেরিয়ে বাংলা কবিতায় নতুন রক্ত আনতে পারলেন। (৫) নজরুলের কবিতায় ত্রুটি আছে।
সে ত্রুটি মূলত উত্তেজনা জনিত, পুষ্টির অভাবে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব স্থায়ী না হলেও নতুনদের মনে তিনি একটা আকাঙ্ক্ষা বা জাগরণ তৈরি যে করতে পেরেছিলেন তা বলা বাহুল্য। অন্তত নতুন এক বিশাল পাঠক সমাজ তৈরি করতে পেরেছিলেন নজরুল। তিনি নিজেই ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় স্বীকার করেছেন তিনি হুজুগের কবি কারণ ‘যারা কেড়ে খায় ৩৩ কোটি লোকের মুখের গ্রাস’, তার লেখায় যেন তাদের সর্বনাশ ঘটে। এবং তিনি আরও স্বীকার করেছেন চিরকালের কবি হলেন রবীন্দ্রনাথ।(৬) সর্বোপরি নজরুলের ছিল এক বিশিষ্ট প্রতিভা। যে প্রতিভার বলে তিনি একজন সঙ্গীতজ্ঞ, সুরকার এবং সমকালীন অন্যায় অবিচার শোষণ এবং পরাধীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সোচ্চার। আর প্রতিভা যার আছে তিনি কেন অনুকরণ করবেন? তাই নজরুল বাংলা কবিতায় আনলেন নতুন যুগ। তিনি অতিক্রম করলেন রবীন্দ্রনাথের প্রভাবকে এবং বাঞ্ছিত এক পরিবর্তনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুললেন যার ফলে কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকদের আবির্ভাব ঘটল। সমকালীন যুগের যে চাহিদা ছিল নজরুল সেই চাহিদাকে নিজের মধ্যে সাঙ্গীকৃত করে প্রতিবাদী চেতনায় জারিত করে যেভাবে সাধারণ মানুষের তৎকালীন মূল আকাঙ্ক্ষা গুলিকে তাঁর কাব্যে রূপায়িত করেছেন তাতেই তিনি তার কাব্যের মৌলিকত্বের প্রমাণ রেখে গেছেন।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদি আন্দোলন, ওয়াহাবি আন্দোলন, খিলাফত, সোভিয়েত বিপ্লব, অসহযোগ আন্দোলন এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট থেকে তিনি মুখ ফিরিয়ে থাকেননি বরং সকলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত থেকে স্বাধীন মতবাদকে তুলে ধরেছেন জনসম্মুখে। তিনি উপলব্ধি করেছেন অত্যাচারের অবিচারের শাসন শোষণের আঘাতে আঘাতে মানুষ কিভাবে জর্জরিত হয়, মায়ের বুক থেকে সন্তান অপহৃত হয়, অনৈক্যের চোরাবালি, ভ্রাতৃ বিচ্ছেদ জনিত লজ্জা, সাম্প্রদায়িক হানাহানি, পারস্পারিক কলহ স্বার্থপরতার কানাগলিতে অজস্র শিশুর প্রাণ বলিদান হয়। সহিংস প্রবল উদ্ধত অন্যায় আর সাম্রাজ্যবাদী লোভ-লালসায় অজস্র প্রান উৎসর্গীকৃত হয়। সমকালীন যুগের এই বাস্তব রূপ ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় নানাভাবে ব্যক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রোত্তর কাব্যে নজরুলের মৌলিকত্বের আরো এক কারণ তিনি মানুষের কবি। তিনি সব মানুষের সমান অধিকার ও সম্ভাবনার দিকে জোর দিয়েছেন এবং মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, যৌবন প্রেম, বীরধর্ম প্রকৃতি নিয়ে কবিতা লিখেছেন। আর এগুলি তাকে পরবর্তীকালে কবিদের কাছে নতুন পথের দিশা যুগিয়েছে।
নজরুলের কাব্য আলোচনার আগে তার কবি স্বভাবের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে তার নিজের কথাগুলি জেনে নেওয়া দরকার। যেমন, (১) ‘আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা, পায়ে পদ্মফুল দেখিনি, তার চোখে চোখ ভরা জল দেখেছি ৃ ফাঁসির মঞ্চে তাকে দেখেছি, আমার গানে সেই সুন্দরকে রূপে রূপে অপরূপ দেখার স্তব-স্তুতি।” (২) “স্রষ্টাকে আমি দেখিনি কিন্তু মানুষকে দেখেছি এই ধূলিমাখা পাপলিপ্ত অসহায় দুঃখী মানুষই একদিন বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত করবে। কিছু করতে যদি নাই পারি তাদের সাথে প্রাণভরে যেন কাঁদতে পারি।” ( ৩) “ফুল ফোটানোই আমার ধর্ম। তরবারি আমার হাতে বোঝা, কিন্তু তাই বলে তাদের ফেলেও দিইনি।” (৪) “জনগণের সাথে সংযোগ সুদৃঢ় করতে হলে তাদের আত্মীয় হতে হবে, তারা আত্মিয়ের মধুর বুলিকে গ্রাহ্য করে না। ওদের সাহিত্যের মধ্য দিয়ে ওদেরকে শিক্ষা দিতে হবে।” ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে তাঁর শক্তিশালী, সাহসী, বলিষ্ঠ ও সুস্পষ্ট অবস্থানের কারণের জন্য বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত। বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য ও বিশ্ময় প্রতিভার নাম কাজী নজরুল ইসলাম।
কবিতা, নাটক, উপন্যাসের মতো সাহিত্যের প্রতিটি স্থরেই তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ। তিনি নিজেই লিখতেন গান, দিতেন সেই সব গানের সুর, এবং সেই সাথে গাইতেন গসন ও অর্থাৎ তিনি গীতিকার, সুরকার গায়ক – যা ছিল তাঁর ব্যাতিক্রম গুন- যা মানুষের মাঝে থাকে না। এ ছাড়া তিনি সাংবাদিক হিসেবে ধরেছিলেন কলম, করেছিলেন শোষন আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে নানা আন্দোলন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ধর্মান্ধ নয় তবে ধর্মভীরু ছিলেন, তিনি পবিত্র কোরআন এর আলোকে মহনবী হযরত মোহম্মদ (সাঃ) এর শানে অসংখ্য ইসলামি গান, গজল, হামদ নাত রচনা করেছেন। আমাদের দেশে যে হামদ নাত গুলো রেডিও টেলিভিশন সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয় তার প্রায় সবকটিই কাজী নজরুল ইসলাম এর রচনা।
মৃত্যু পরবর্তী তার দাফন এর ব্যাপারে তিনি লিখলেন,”মসজিদের পাশে আমার কবর দিও ভাই যেন কবরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই আমার কবরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজীরা যাবে পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে মোর-আযাব থেকে এ গুনাহগার পাইবে রেহাই। সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি, খোদা তোমার মেহেরবানি… কি চমৎকার তার সৃষ্টি। তিনি বাংলা, ফার্সি, উর্দু ভাষায় অসংখ্য ইসলামি গান লিখেছেন, যা মুসলমানদের জীবনে স্বরণীয় হয়ে থাকবে।মোঃ আব্দুল হান্নান রঞ্জন এডভোকেট , সহ-সভাপতি, সাধারণ গ্রন্থাগার, নেত্রকোণা।
Leave a Reply