মোঃ আব্দুল হান্নান রঞ্জন: বাঙ্গালী জাতির জাতীয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত অর্জন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
১৯৪৭সালে দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে ভারত বর্ষে হিন্দুস্তান এবং পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। পূর্ব বাংলা হলো পাকিস্তানের অংশ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান।
ঐ সময় বাঙ্গালী জাতি তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আশা করেছিলেন, এবার হয়তো তাদের আশা-আকাঙ্খা পূরণ হবে। তাঁদের প্রত্যাশিত স্বাধীনতা নতুন রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হবে। বাঙ্গালীদের জীবন-মান উন্নত হবে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগন উন্নত জীবনের অধিকারী হবেন। কিছুদিনের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অনুভব করলেন, তাদের প্রত্যাশা পূর্ণ হওয়ার নয়। পাকিস্তানের শাসকবর্গ বহুবাচনিক সমাজে পূর্ব পরিকল্পিত ঐক্যবদ্ধ একক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করেছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অংশগ্রহণের ক্ষেত্র সংকুচিত করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁরা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। এমন কি পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান সকল ক্ষেত্রই পূর্ব পাকিস্তানের সাথে বৈষম্যমুলক আচরণসহ শোষন আর শাসনের মাঝেই
র্পূব পাকিস্তান স্বাধীনতা সংগ্রামরে পটভূমি তৈরি হয়।
পাকিস্তান প্রথমেই আঘাত হানে পূর্ব পাকিস্তানের মাতৃভাষার উপর। বাঙ্গালী জাতির মাতৃভাষা বাংলা ভাষার উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল উর্দূ ভাষা।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বছর দু’এক বছরের মধ্যেই পাকিস্তান সরকার অর্থাৎ ১৯৪৮ সালেই উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে।
পাকিস্তান সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদ চলতে থাকে যা পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলন নামে রুপ লাভ করে। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলা ভাষার দাবিতে ঢাকা বিশববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ছাত্ররা একত্রিত হয়। পুলিশ এ জনসমাবেশের উপর গুলি চালানোর ফলে রফিক, সালাম, বরকত, জববারসহ আরো অনেকে শহীদ হয়।
ভাষা শহীদদের রক্তে রঞ্জিত এই ভাষা আন্দোলন তৎকালীন সময়ে রাজনৈতিক গুরুত্ব বহুমাত্রায় বেড়ে যায়। ফলশ্রুতিতে, ১৯৫৬ সালে চূড়ান্তভাবে পাকিস্তান সংবিধানে বাংলাকে উর্দূর পাশাপাশি অন্যতম প্রধান জাতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
ভাষা আন্দোলনকে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
১৯৫৪ সালে ১০ই র্মাচ পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে র্পূববঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। কিন্তু পাকিস্তান শাষকগোষ্ঠী বাঙালির এই আধিপত্য মেনে নিতে না পারার কারণেই মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দেয়।
এই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা দখল করে নেয়।
১৯৫৯ সালে সমগ্র পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের সময় নির্ধারিত হলে বাঙালিদের মধ্যে বিপুল সাড়া দেখা দেয়। জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ বাঙালি, অতএব এই নির্বাচনের ফলাফল চিন্তা করে কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। একই সময়ে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের কৌশলে কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যেও বিরোধ সৃষ্টি করে।
১৯৬২ সালে সামরিক শাসন তুলে নেয়া হ’লে ছাত্র সমাজ অধিকারের দাবিতে পুনরায় আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়।
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাঙ্গালী জাতির রাখাল রাজা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালীর স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষে ছয় দফা দাবি পেশ করেন।
এই ঐতিহাসিক ছয় দফা ম্যান্ডেট নিয়ে পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে।
তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামীলীগের উত্তরণ ঘটায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিশ্বাস ছিল, পাকিস্তান সরকার নিয়মতান্ত্রিকভাবে জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ট নির্বাচিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে এবং আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে পাকিস্তান সরকার গঠন করবে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তথা পাকিস্তানের শাসকবর্গ জনগনের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে কতিপয় রাজনৈতিক নেতা এবং কিছু সামরিক কর্মকর্তা-গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালি জাতির উপর বেআইনী কর্মকান্ড সহ সম্পূর্ণ অন্যায়-অবিচার, জুলুম, শোষন, নিপীড়ন আর নির্যাতনের পথ বেছে নেয় যার ফলশ্রুতিতে বাংলার জনগণ তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনগনকে অধিকার আদায়ের দৃঢ় প্রত্যয়ে লড়াই, সংগ্রাম, আন্দোলনে রাজপথে নামতে বাধ্য করে। যে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারন করে এবং এক পর্যায়ে এই আন্দোলন অসহযোগ আন্দোলনে রুপ নেয়।
পূর্ব-বাংলার স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে দেশব্যাপী তীব্র গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। অধিকার আদায়ের ঐই আন্দোলনে রাজনৈতিক শ্লোগান পরিবর্তিত হয়। ” তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা।” ” পিন্ডি না ঢাকা- ঢাকা ঢাকা।”
“জাগো জাগো-বাঙালি জাগো”।
এই ধারাবাহিকতায় স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথকে উন্মক্ত করে। অহিংস আন্দোলন সহিংসতার দিকে ধাবিত হতে থাকে। এই সময় রাজনৈতিক দলের ৬ দফা দাবি গণদাবিতে পরিণত হয়। বাঙালি একক জাতিসত্তার আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইয়ুব খান দেশে সামরিক শাসন জারি করে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
এই গণ-আন্দোলনের সময় অর্থাৎ ১৯৬৯ সনের ২০শে জানুয়ারী পুলিশের গুলিতে ছাত্র আসাদুজ্জামান এবং ২৪শে জানুয়ারী স্কুল ছাত্র মতিউর রহমান মৃত্যুবরণ করে।
ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকায় শহীদ আসাদ-মতিউর দুটি উল্লেখযোগ্য নাম। শেরে বাংলা নগর ও মোহাম্মদপুরের সংযোগ স্থলের আইয়ুব গেটের নাম পরিবর্তন করে ‘আসাদ গেট’ এবং বঙ্গভবনের সামনের উদ্যানের নাম ‘মতিউর রহমান শিশু উদ্যান’ করা হয়।
১৯৬৯ সালের জানুয়ারী মাসে বাংলার ছাত্রসমাজ গৃহীত ছাত্রদের ১১ দফা এ আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তুলে। ১৯৬৯ সনের ১৫ই ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত অবস্থায় বন্দী আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক মৃত্যুবরণ করেন। ১৮ই ফেব্রুয়ারি’ ৬৯ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ডঃ শামসুজ্জোহা পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এই মৃত্যু সংবাদ গণ-আন্দোলনে আরেকটি নতুন মাত্রা যুক্ত করে। প্রচন্ড-আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৯ সনের ২১শে ফেব্রুয়ারি’ এই মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। এবং ১৯৬৯ সনের ২২শে ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবর রহমানসহ অভিযুক্ত সকলেই ঢাকা সেনানিবাস থেকে মুক্তি লাভ করেন। এই আন্দোলনের সৃষ্ট গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির একক এবং অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং ১৯৬৯ সনের ২৩শে ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল গণ-সম্বর্ধনায় শেখ মুজিবর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
এই মামলায় অভিযুক্ত ও বন্দী অবস্থায় সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ডঃ শামসুজ্জোহাকে জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। উভয়েই স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক হিসাবে চিহ্নিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সার্জেন্ট জহুরুল হক হল’ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শামসুজ্জোহা হল’ তাদের স্মরণে নামকরণ করা হয়েছে।
‘৬৯ এর এই ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ, আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, তোফায়েল আহমেদ, আসম আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, সামসুদ্দোহা, মোস্তফা জামাল হায়দর, রাশেদ খান মেনন, বেগম মতিয়া চৌধুরী, দীপা দত্ত, হায়দর আকবর খান রণোসহ অনেকে।
রাজনৈতিক দলীয় প্রধান যাদের নিরলস পরিশ্রম ও নির্দেশনায় বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের এই আন্দোলন পূর্ণতা লাভ করেছিল তাদের মধ্যে জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, কমরেড মনি সিং, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, শ্রীমনোরঞ্জন ধর অন্যতম।
১৯৬৯ সনের ২৫শে মার্চ সারা দেশে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর হলেও সামরিক সরকার গণ-দাবিকে উপেক্ষা করার মত শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি। তাই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সারা দেশে এক ব্যক্তি এক ভোটের নীতিতে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন।
১৯৭০ সনের ৭ই ডিসেম্বর থেকে ১৯শে ডিসেম্বর এর মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে মর্মে সাধারণ নির্বাচনের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করে এবং শান্তিপূর্ণভাবে দেশব্যাপী এই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ৬ দফা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে রায় প্রদান করে। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ৩১০ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের ম্যান্ডেট লাভ করে।
” বাঙালির শাসন মেনে নেওয়া যায় না “– এই নীতিতে পাকিস্তানি সামরিক শাসকগণ নির্বাচিত এই জন প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিবন্ধক হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার জাতীয় নেতৃবৃন্দ এর প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ায়। শুরু হয় অধিকার আদায়ের সংঘাত। ছাত্র সমাজ এই আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। ১৯৭০ সনে বঙ্গবন্ধু এক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে পূর্ব বাংলার ম্যাপ অংকিত একটি পতাকা প্রদান করেন। এই পতাকাই পরবর্তীতে বাংলাদেশের পতাকা হিসাবে গৃহীত হয়। ছাত্রদের এই সংগঠন প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে প্রতিটি জেলা ও মহকুমা শহরে শুরু হয় সামরিক প্রশিক্ষণের মহড়া। জাতীয়তাবাদী এই আন্দোলনে ছাত্র ও যুব সমাজের অংশগ্রহণ জন সমাজকে আরো উৎসাহিত করে তোলে।
জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভের পর পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠনে মত প্রদানে অস্বীকার করেন। একটি রাজনৈতিক দল জনগণের ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠনের ম্যান্ডেট পেয়েছে। তারা সরকার গঠন করবে, এটাই ছিল নিয়ম এবং বাস্তবতা। কিন্তু সামরিক শাসকগণ সরকার গঠন বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে আলোচনার নামে টালবাহানা শুরু করে এবং জাতীয় সংসদের নির্ধারিত অধিবেশন স্থগিত করে দেয়।
এরই প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সনের ১লা মার্চ দেশব্যাপী অসহযোগের ডাক দেন। সর্বস্তরের জনগণ একবাক্যে বঙ্গবন্ধুর এই আহবানে সাড়া দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অচল করে তোলে।
২রা মার্চ ৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা প্রদর্শিত হয়। ৩রা মার্চ ‘৭১ এ রমনা রেসকোর্স (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) ” স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ “- এর পক্ষ থেকে ‘স্বাধীনতার ইসতেহার’ পাঠ করা হয়। এই ইসতেহারে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পরিচালিত সরকার জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে কোন সমাধান না দেওয়ায়, ১৯৭১ সনের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সমগ্র বাঙালি জাতিকে এক দিকনির্দেশনী ভাষণে সর্বপ্রকার পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হতে উদাত্ত আহবান জানান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি যাহা বলেছিলেন, তাহা নিম্নে প্রদত্ত হইলঃ–
আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।
আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম, নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব এবং এই দেশকে আমরা গড়ে তুলব, এ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তেইশ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। তেইশ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর–নারীর আর্তনাদের ইতিহাস; বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে দশ বৎসর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯-এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পর যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন। আমরা মেনে নিলাম।
তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাঁকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসব। আমি বললাম, অ্যাসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব; এমনকি আমি এ পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজনও যদি সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।
জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন যে আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরও আলোচনা হবে। তারপর অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ করলাম, আপনারা আসুন বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসেন, তাহলে কসাইখানা হবে অ্যাসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলে দেওয়া হবে। যদি কেউ অ্যাসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, অ্যাসেম্বলি চলবে। তারপর হঠাৎ ১ তারিখে অ্যাসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো।
ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসাবে অ্যাসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাব। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপরে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো। দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্দুকের মুখে মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।
আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
কী পেলাম আমরা? যে আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী আর্ত মানুষের বিরুদ্ধে, তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু। আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি, তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। টেলিফোনে আমার সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের উপরে গুলি করা হয়েছে, কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স ডাকব।
আমি বলেছি, কিসের বৈঠক বসবে, কার সঙ্গে বসব? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসব? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার উপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের উপর দিয়েছেন।
ভাইয়েরা আমার, ২৫ তারিখে অ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি যে ওই শহীদের রক্তের উপর পা দিয়ে কিছুতেই মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেম্বলি কল করেছে। আমার দাবি মানতে হবে: প্রথম, সামরিক আইন মার্শাল ল উইথ ড্র করতে হবে, সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে, যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে, আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে । তারপর বিবেচনা করে দেখব, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না।
আমি, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যে আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে, সেগুলির হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, গরুর গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে; শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেণ্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না।
২৮ তারিখে কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন। এর পরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।
আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করব। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকাপয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। আর এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাঁদের বেতন পৌঁছায়ে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো, কেউ দেবে না। মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটপাট করবে। এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান বাঙালি অবাঙালি যারা আছে, তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন রেডিও টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনেন, তাহলে কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোনো বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। দুই ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়নাপত্র নিবার পারে। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে চালাবেন। কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে–শুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।……
৭ই মার্চের এই ভাষণে বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশে দেশের সর্বস্তরের ছাত্র, জনতা ও বুদ্ধিজীবীদের সাথে বাঙালি সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী সকলকেই সচেতন করে তোলে।
১৯৭১ সনের ২রা মার্চ থেকে পূর্ব বাংলার সমস্ত প্রশাসনিক কাজকর্ম চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে।
২৩শে মার্চ সকালে পল্টন ময়দানে জয় বাংলা বাহিনীর এক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠান শেষে এই বাহিনীর নেতৃবৃন্দ মিছিল সহকারে বাংলাদেশের পতাকাসহ বঙ্গবন্ধু ভবনে প্রবেশ করে আনুষ্ঠানিকভাবে বাড়িতে এই পতাকা উত্তোলন করেন। একই সাথে বঙ্গবন্ধুর গাড়িতে এই পতাকা লাগান হয়। ২৩শে মার্চ পূর্ব বাংলার প্রতিটি শহরে পাকিস্তান দিবসের অনুষ্ঠান বর্জিত হয় এবং পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখা যায়।
অন্যদিকে ক্ষমতার হস্তান্তরের নামে এই আলোচনা চলা অবস্থায় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো সৃষ্ট সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে নতুন করে সংকটের সৃষ্টি করে। অযৌক্তিক দাবি উপস্থাপনের ফলে সুষ্ঠু রাজনৈতিক সমাধানের পথ এক সময় রুদ্ধ হয়ে পড়ে। পাকিস্তান সামরিক শাসকগণ স্বার্থান্বেষী মহলের সাথে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের জন্য রাজনৈতিক আলোচনার আড়ালে সামরিক বাহিনী মাত্র ২২ দিনে দুই ডিভিশন অবাঙালি সৈন্য পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলায় আনয়ন করা হয় যা ছিল তাদের আলোচনার নামে কালক্ষেপণের মূল উদ্দেশ্য।
১৯৭১ সনের ২৪শে মার্চ পাকিস্তান সামরিক শাসকগণ হেলিকপ্টার যোগে সমস্ত সেনানিবাসে এই আক্রমণের পরিকল্পনা হস্তান্তর করে এবং বাঙালি জাতির উপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্দেশে ” অপারেশন সার্চ লাইট”- নামে কুখ্যাত হত্যাযজ্ঞ চালায়।
১৯৭১ সনের ২৫শে মার্চ রাত্র ১১টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে বাঙ্গালীদের উপর আক্রমণ করে। একই সাথে ঢাকাসহ দেশের সমস্ত বড় শহর ও সেনানিবাসের বাঙালি রেজিমেন্টসমূহ আক্রান্ত হয়। সেনাবাহিনীর হাতে বঙ্গবন্ধু রাত ১২টা ৩০ মিনিটে ধানমন্ডি বাসভবন থেকে বন্দী হবার পূর্বে তিনি দলীয় নেতৃবন্দেকে করণীয় বিষয়ে যথাযথ নির্দেশ দিয়ে অবস্থান পরিবর্তনের কথা বলেন। একই সাথে তিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হয়।
স্বাধীনতাকামী বাঙালী জাতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় পাবার পর ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধের চেষ্টা চালায়…. মুক্তিবাহিনী গঠন করে জীবন বাজি রেখে মাতৃভূমিকে হানাদার মুক্ত করতেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ যা সশস্ত্র সংগ্রাম ও রক্তাক্ত মুক্তিযোদ্ধ হিসেবে পরিগণিত হয়। বাংলার ছাত্রসমাজ, কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষ ঝাপিয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধে— টানা নয় মাস চলে এই রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ। এই নয় মাসের যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী গ্রমের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, নীরিহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে, সারাদেশ ব্যাপী চালায় হত্যা ধর্ষণ, লুন্ঠন —- আর ওদের এ ধরণের ন্যাক্কার জনক ঘৃনীত কাজে সহায়তা করে মুসলিম লীগ, জায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম নামে এদেশেরই কতিপয় দালাল, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও আল-মুজাহিদর চিহ্নিত লোকজন।
এতদ্ব সত্বেও টানা নয় মাসে ৩০ লক্ষ শহীদ আর দূ’লক্ষ মা-বোনদের ইজ্জ্বতের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম এই বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালী জাতি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাক হায়েনাদের পরাজিত তথা পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর আত্নসমর্পণের মধ্য দিয়ে কাঙ্খিত বিজয় অর্জন করে।
এখানে উল্লেখ্য যে, ত্রিশ লক্ষ মানুষকে একের উপর আরেকজনকে শোয়ানো হয় তবে তার উচ্চতা হবে ৭২০ কিলোমিটার, যা মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতার ৮০ গুন আবার ত্রিশ লক্ষ মানুষ যদি হাতে হাত ধরে দাঁড়ায় তবে তার দৈর্ঘ্য হবে ১১০০ কিলোমিটার, যা টেকনাফ হতে তেতুলিয়ার দূরত্বের চেয়েও বেশী।
অপরদিকে ত্রিশ লক্ষ মানুষের শরীরে মোট রক্তের পরিমান ১.৫ কিলোলিটার যা শুকনো মৌসুমে প্রতি সেকেন্ডে প্রবাহিত পানির সমান।
তারপরও হয়তো আমরা কখনই বুঝবো না বা বুঝতে চেষ্টা করবো না, বাঙ্গালি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে কতটা মূল্যদিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছে। এখানে কবির ভাষায় বলতে হয়, ” দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা — এ বাংলা কারো দানে নয়।
বিশ্ব মানচিত্রে আজ বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন বাংলাদেশ এর মানচিত্র এবং যার জমিনের উপর পতপত করে উড়ছে লালসুজের একটি পতাকা।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদ আর সম্ভ্রম হারনো দুই লক্ষ মা -বোনদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে সবুজ আয়তক্ষেত্র বা সবুজ জমিনের উপর লাল বৃত্তের মাঝে নিহিত রয়েছে আমাদের ভালবাসা আর অহংকার।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে কবি তার কবিতায়, গায়ক তার গানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিবাহিনীকে উৎসাহ, উদ্দীপনাসহ পেরণা যুগিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে বহুল প্রচারিত এবং জনপ্রিয় একটি গান নিম্নে প্রদত্ত হইল। গানটি…. শাহ বাঙ্গালী’র কথায় এবং সুর ও শিল্পী আব্দুল জব্বারের কন্ঠে প্রেরণা যুগিয়েছে….
” মুজিব বাইয়া যাওরে
নির্যাতিত দেশের মাঝে…. জনগনের নাওরে ….মুজিব বাইয়া যাওরে….
মুজিব রে….
ছলে বলে ২৪ বছর…. রক্ত খাইল চুষি….
জাতিরে বাঁচািতে গিয়া…. তমি হইলা দোষী রে…
মুজিব বাইয়া যাওরে…..
মুজিব রে….
ক্ষিদের জ্বালায় হৃদয় কালা….
সপে থালা মুখে…. কথায় কথায় চালায় গুলি….
বাঙালীদের বুকে রে….. মুজিব বাইয়া যাওরে…..।।
মুজিব রে…..
আকাশ কান্দে বাতাস কান্দে….
কান্দে রে বাঙ্গালি …. নিপীরিত মামুষ কান্দে…
মুজিব মুজিব বলে রে….. মুজিব বাইয়া যাওরে…
মুজিব রে…… বাঙ্গালীদের ভাগ্যাকাশে….
তুমি বাংলার চির সম্রাট….. তুমি বাংলার চিরসম্রাট
অন্ধকারের শশী রে…. মুজিব বাইয়া যাওরে।
মুজিব বাইয়া যাওরে…. নির্যাতিত দেশের মাঝে
জনগনের নাও রে… মুজিব বাইয়া যাওরে….
মোঃ আব্দুল হান্নান রঞ্জন
এডভোকেট
সহ-সভাপতি, সাধারণ গ্রন্থাগার, নেত্রকোণা।
Leave a Reply